সীতাকুন্ড আদিবাসী ত্রিপুরা গ্রাম সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন

তদন্ত: ১৯-২১ জুলাই ২০১০

On 19-21 July 2010 Kapaeeng Foundation sent a media and human rights team comprising reporters from daily Kaler Kontha, daily Jugantor and The Daily Star to Shitakunda for in-site inquiry where about 15 thousand indigenous people from Tripura community have been living in this place for generations. They all are poor and they are not entitled their basic needs. There are no education, health and sanitation facilities for them. At present they all are landless. A group of land grabber from mainstream Bengali people has become the owner of these lands by making fake documents.

The team visited villages of Tripura community and and talked to local administration including Chairman of the Shitakunda Upazila Mr. Abdullah Al Baker Bhuiyan and Union Parishad Chairman Abdur Rouf. The local administration in Shitakunda seems quite aware and even sympathetic concerning the various problems facing the Tripura people. After coming back from Shitakunda the daily Kaler Kontha, Jugantor and The Daily Star published special story on the sufferings and problems of Tripura indigenous people.

সীতাকুন্ড আদিবাসীদের দীর্ঘ এক যুগের পরও অন্যের জমিতে শ্রমদাস হিসেবে জীবিকা!

কাপেং ফাউন্ডেশন রিপোর্ট

চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলায় মূলত ত্রিপুরা আদিবাসীদের বসবাস। সেখানে আদিবাসীরা যুগের পর যুগ স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তারা যুগে পর যুগ কোন নিজস্ব জমির মালিক হতে পারেনি। সেখানকার আদিবাসীদের চাষাবাদের জন্য অনেক জমাজমি ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাদের দিকে তাকালে দেখা যায় ভিন্নচিত্র। তারা আজ ভীটেমাটি হারিয়ে দিনমুজুরের কাজ করে দিনানিপাত করছে। সেখানকার একজন ত্রিপুরা আদিবাসী প্রতিনিধি জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা এখানে বাস করছি। কিন্তু আমাদের এখনে অন্যের জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে দিনমজুরি দিতে হচ্ছে। কেউ এক দিন মজুরি দিতে না পারলে নিজের টাকা দিয়ে তার বদলে গ্রামের অন্য কোন নারী-পুরুষকে মজুরি নিয়োগ দিতে হয়। তানাহলে জমির মালিক আদিবাসীদের জরিমানা বা শাস্তি দিয়ে থাকে। আদিবাসীদের সবচেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে যেকোন সময় জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া এবং জমিদাররা তাদেরকে সবসময় উচ্ছেদের হুমকি দেয়। চট্টগ্রামে সীতাকুন্তে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ঢালে প্রায় ১০ হাজারের অধিক ত্রিপুরা আদিসাবীর মজুরির দাসত্বের চিত্রটি এভাবেই ফুটিয়ে তুললেন ছোট কুমিরা নামক ত্রিপুরা আদিবাসী গ্রামের নিকুঞ্জ ত্রিপুরা (৭০)। সম্প্রতি সীতাকুন্ডু উপজেলার ছোট কুমিরা, বড় কুমিরা, সুলতানি মন্দির, বাঁশবাড়িয়া, মহাদেবপুরসহ বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। সেখানে সংখ্যালঘু আদিাবসী ত্রিপুরারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভূমিহীন, হত-দরিদ আদিবাসীরা অন্যের জমিতে বসবাস করছে। জীবন জীবিকার জন্য বংশপরস্পরায় তাদের বাধ্যতামূলকভাবে অন্যের জমি ও বাগানে মজুরি দিতে হয়। বিনিময়ে তারা পান মাথাপিছু দৈনিক ১৪০ টাকা। কোন কারণে মজুরি দিতে ব্যর্থ হলে তাদের মজুরি অথবা জরিমানা গুনতে হয়। এত কিছুর পরও ফসলের জমি ও ফলবাগানের সম্পদ ভোগ করার কোনো অধিকার তাদের নেই। সীতাকুন্ডের ছোট কুমিরা গ্রামের মথুরা ত্রিপুরা (৫৮) ক্ষোভের সাথে জানান, ১৫০ থেকে ২০০ বছর পূর্ব থেকে পাহাড়ের বুকে বসতি গড়লেও আজ পর্যন্ত জমির মালিক বা ইজারাদার হতে পারেননি পাহাড়ি আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠিরা। এখানে শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, সুপেয় পানি বা বিদ্যুৎ সুবিধা নেই বললেই চলে। বসবাসের জন্য একেকটি গ্রাম থেকে তাদের জমির মালিককে বছরে পাঁচ হাজার টাকা খাজনা দিতে হয়। তিনি আরো জানান, জমির মালিক জহিরুল যদিও সে স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছে না। তারপরও সেখানে তিনি জমি দখল করে রেখেছে। এখানে আদিবাসীরা কৃষি কাজ করতে চাইলে জমির জন্য আলাদা করে খাজনা দিতে হয়। শতক প্রতি ৭০ টাকা খাজনা দিতে হয়। এ কারণে চোখের সামনে জুমের জমি পরে থাকলেও সেদিকে বিন্দুমাত্র পা বাড়াতে পারিনা। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়সহ আশপাশের পাহাড় ও টিলার পাদদেশে অবস্থিত একাধিক ত্রিপুরা আদিবাসী গ্রাম ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে এ চিত্র।

বন বিভাগের সংরক্ষিত পাহাড় ও বনাঞ্চল এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন টিলায় অনুমতি না থাকায় তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন জুম চাষ ও শিকারের ঐতিহ্য। উপরন্তু প্রতি মুহূর্তে তারা ভোগেন উচ্ছেদ আতঙ্কে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ত্রিপুরাদের এই দুরবস্থা সম্পর্কে তাঁরা ওয়াকিবহাল। কিন্তু সীতাকু-ের জায়গাজমি অকৃষিভুক্তবলে চিহ্নিত হওয়ায় সেখানকার খাসজমিতে তাঁদের পুনর্বাসনে আইনগত সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তাঁদের মতে, তবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল সিদ্ধান্ত নিলে বিশেষ বিবেচনায় নীতিমালা শিথিল করে ত্রিপুরা আদিবাসীদের খাসজমিতে পুনর্বাসন করা সম্ভব। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

ছোট কুমিরা ত্রিপুরা গ্রামের কর্ণরাম ত্রিপুরা (৪০) জানান, ব্রিটিশ আমলে তাদের পূর্বপুরুষরা পাহাড় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান সেখানে ৯০টি পরিবারের বসবাস। আশপাশের টিলাসহ গ্রামটি অনেক বছর ধরে জহুর আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির ইজারাধীন। প্রতিদিন সকালে গ্রামের নারী-পুরুষরা মালিকেররাবার বাগানে কাজ করতে যান। সেখানে বাগান পরিষ্কার করার পাশাপাশি জঙ্গল থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ । এই করে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন কাটছে।

মহাদেবপুর ত্রিপুরা গ্রামে কোনো স্কুলও নেই। নিপীড়িত-নির্যাতিত, লাঞ্চিক-বঞ্চিত সেখানে বসবাসকারী ৪৫টি আদিবাসী পরিবার শিক্ষার আলো  পৌঁছায়নি এবং আরো ভিন্ন ধরনের শোষণ-নিপীড়নের শিকার।  সেখানকার বাসিন্দা পঞ্চকুমার ত্রিপুরা (৬৫) জানান, প্রায় ৩৫ বছর আগে জঙ্গল পরিষ্কার করে তাঁরা গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানকার ইজারাদার ইস্কান্দর চৌধুরীর সঙ্গে মৌখিক চুক্তিতে গ্রামবাসী আশপাশের টিলায় বিশাল কাঁঠাল বাগান ও পেয়ারা বাগান তৈরি করেন। তখন কথা ছিল, আদিবাসীরা প্রতিবছর এসব ফলের আধাআধি ভাগ পাবেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই চুক্তির কথা অস্বীকার করেন ইজারাদার। তখন থেকেই ফলদ সম্পদের ওপর অধিকার হারিয়ে আদিবাসীরা নিজেদের তৈরি ফলবাগানে বাধ্যতামূলক শ্রম দিয়ে আসছেন। ইজারাদারের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেরা বাগান ও গ্রামের ইজারাদার হয়েছেন। কিন্তু আদিবাসীদের ভাগ্য ফেরেনি। একই গ্রামের বাসিন্দা মনিবালা ত্রিপুরা (৫০) বলেন, ‘মালিক আমাদের জমি থেকে উঠে যেতে বললে যে কোনো সময় উচ্ছেদ হতে হবে। তখন আমরা যাব কোথায়? ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে খাব কী? এখানে তবু কোনো রকমে বেঁচে তো আছি!সুলতানী মন্দির ত্রিপুরা গ্রামে মৃগো ত্রিপুরা (২৫) বলেন, ‘পরের জমিতে দিনমজুরি করে বউ-বাচ্চার মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেওয়াই দায়। শুনেছি ছয়-সাত মাস পরে এই গ্রাম ছেড়ে আমাদের ২২টি পরিবারকে উঠে  যেতে হবে। ইজারাদার বসতিগ্রাম তুলে দিয়ে এখানে ফলের বাগান করবেন।

রাবার বাগান এলাকার চন্দ্রীরাম ত্রিপুরা (৫০) জানান, পৈতৃক সূত্রে তিনি ১১ একর ৩৪ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল ভুয়া দলিল তৈরি করে বছর দশেক আগে তাদের তিন ভাইকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে। এখন তারা মিরসরাইয়ের নলকূপাড়ায় অন্যের জমিতে বাস করছেন। বার্তমানে চন্দীরামর ছোট ভাই শ্রমদাস হিসেবে নিজে পৈতৃক জমিতে দখলকারীর সাথে বসবাস করছে।

একই গ্রামের বিশ্বপতি ত্রিপুরা (৪৫) বলেন, ‘৫০-৬০ বছর আগে বাপ-দাদারা এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন গ্রামটি ছেড়ে আমরা কোনদিকে যাব? কোথায় আশ্রয় পাব? কিচ্ছু জানি না! আমাদের সরলতা নিয়ে সীতাকুন্ত স্থানীয় প্রভাবশালী লোকেরা তাদের বাস্তুভীটা থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার তালবাহানা চলছে।। এখন তারা নিজের ভিটে মাটিতে বসবাস করতে পারছে না।

দয়ামতি ত্রিপুরা (৭০) বলেন, আমরা ফল বাগান লাগালেও মালিকের লোভ পড়ে যাওয়া সেই ফল আর আমরা খেতে পারি না। ফলের মৌসুমে মালিকের লোকজনই সব ফল নিয়ে যায়। আদিবাসীরা মজুরীর বিনিময়ে  বাগানে শুধু শ্রম দেয়।

চিন্তামনি ত্রিপুরা জানান, এই গ্রামে আগে ৪৬টি পরিবার বসবাস করলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে ১৭টি পরিবার ইতিমধ্যে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বীরেন্দ্র ত্রিপুরা, সুমি ত্রিপুরা, বিশ্বচন্দ্র ত্রিপুরা, শুভ্রত ত্রিপুরা, সমীর ত্রিপুরা, চন্দ্র সাধু ত্রিপুরা, এখন অন্যরাও চরম অনিশ্চতার মধ্যে রয়েছে। জমি মালিক যে কোন সময় উচ্ছেদ করে দিতে পারে তখন আমাদের টিলা ছাড়তে হবে। এ কারণে এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন এখানকার আদিবাসী পরিবারগুলো। একই অবস্থা কুমিরা ইউনিয়নের জুমাপাড়া (সুলতানা মন্দির) সংলগ্ন ত্রিপুরা গ্রামেও। এখানে ২২টি পরিবারের প্রায় ১৫০ সদস্য বসবাস করছেন। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করলেও এখন যেকোন সময় উচ্ছেদ হতে পারেন এমন আতংকে কাটছে এই পাড়ার আদিবাসীদের। চট্টগ্রামের জনৈক ইসলাম হচ্ছেন এই ত্রিপুরা পল্লী সংলগ্ন এলাকার টিলার ইজারাদার। ওই সূত্রে তিনি ত্রিপুরা গ্রামটিও দখল করে নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। এ কারণে মালিক পক্ষ যখনই চাইবে তখনই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে ত্রিপুরা আদিবাসীদের ২২টি পরিবার।

সেখানকার আদিবাসী গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক বছর আগে ইপসানামের একটি বেসরকারি সংস্থা সেখানে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বেশকিছু আদিবাসী ছেলেমেয়ে সেখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আদিবাসী গ্রামে ইপসাছাড়া অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এখনো কোনো রকম নাগরিক সুবিধাই গ্রামটিতে পৌঁছে দেয়নি। পানীয়জলের জন্য এখনো গ্রামবাসী পাতকুয়া ও ছড়ার উপর নির্ভরশীল।

সীতাকু-ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রউফ আমাদেরকে জানান, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভূমিহীন ত্রিপুরাদের সরকারি খাসজমিতে বন্দোবস্ত দিয়ে পুনর্বাসন করা সম্ভব নয়। কারণ সরকারি ঘোষণাপত্রে সীতাকু- অঞ্চলকে অকৃষি জমিবলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূমি আইন অনুযায়ী, এ ধরনের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যায় না। তিনি আরো জানান, ত্রিপুরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করতে হলে, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া জানান, আইন মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি। তবে তিনি সব সময় ত্রিপুরাদের সঙ্গে আছেন বলে দাবি করেন । চেয়ারম্যান আরও বলেন, আদিবাসীরা যদি সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছে একটা লিখিত আবেদন করে জমি ইজারা পাওয়ার জন্য তাহলে চেয়ারম্যনা হিসেবে তিনি সেটি নিয়ে সরকারের সাথে দেন দরবার করবেন। ত্রিপুরা আদিবাসী জণগোষ্ঠিকে রক্ষা করার জন্য যা করা দরকার তার সবই তিনি করবেন। তিনি বলেন, বাঙালীরা যদি পাহারে জমি ইজারা নিয়ে বসবাস করতে পারে, তাহলে পাহাড়ীরা কেন জমি ইজারা নিয়ে বসবাস করতে পারবে না। কিছু ভূমিদস্যু এসব পাহাড় দখল করে খাচ্ছে, অথচ পাহাড়িরা দৈন্য জীবনযাপন করছে।তাই সরকার চাইলে নীতিমালা শিথিল করে ত্রিপুরা আদিবাসীদের বিশেষ বিবেচনায় খাসজমিতে পুনর্বাসন করা সম্ভব। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

সীতাকুন্ড আদিবাসীদের খাসজমিতে পূণৃবাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এখানে রাষ্টীয় পৃষ্ঠপৌষকতা অত্যন্ত জরুরী। এটি রজনৈতিক ভাবে সমাধান না করলে এটি সমাধান করা সম্বব নয়।