রামু, উখিয়া এবং পটিয়ার ঘটনাবলী সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন

তদন্ত: ৬ ও ৭ অক্টোবর

 রামু, উখিয়া এবং পটিয়ার ঘটনাবলী সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দলের

সংবাদ সম্মেলন

১২ অক্টোবর, শুক্রবার, সকাল ১১টা

ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি, গোলটেবিল কক্ষ, সেগুনবাগিচা, ঢাকা।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ

গেলো ২৯-৩১ সেপ্টেম্বর ২০১২ রামু, উখিয়া এবং পটিয়ার বৌদ্ধবিহার, হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসতবাড়িতে যে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নিপীড়ন-নির্যাতনের যে ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে তা সরেজমিনে  দেখার জন্য রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মানবাধিকার কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত ১৩ সদসস্যের একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন; গত ৬ ও ৭ অক্টোবর ২ দিনব্যাপী অনুসন্ধানে প্রতিনিধিদল আক্রান্ত জনপদের বিভিন্ন স্তরের গণ-মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভষ্মীভূত বৌদ্ধ বিহার ও ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরসমূহ পরিদর্শন করেন, ভুক্তভোগী মানুষ, বিহারের ভান্তে, অধ্যক্ষ, স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। নাগরিক প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার জন্য আজ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি। সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টচার্য্য, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর-এর ট্রাস্টি তারিক আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, আইইডি নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মেদ খান, আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নীলুফার বানু, সাংবাদিক সালিম সামাদ, কাপেং ফাউন্ডেশন-এর ভাইস চেয়ারপার্সন দীপায়ন খীসা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজীব মীর, মানবাধিকার কর্মী নায়লা বারী, সাংবাদিক ইয়াসমিন পিউ, নাদিয়া শারমিন ও হারুনুর রশীদ।

উপস্থিত সাংবাদিকবৃন্দ

আমরা মনে করি, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ে যে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তাতে আমরা যারপরনাই মর্মাহত ও লজ্জিত; সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির উলম্ফন ও তা-বলীলা দেখে একই সঙ্গে আমরা বিচলিত ও শঙ্কিতও; প্রেম, মানবতা, ক্ষমা, অহিংসা, শিক্ষা, সভ্যতা Ñ এই হলো বৌদ্ধ ধর্মের মূল বাণী। বাংলাদেশে দশ লাখ বৌদ্ধ বাস করেন, ছয় লাখ সমতলে আর চার লাখ পাহাড়ে; অহিংস নীতির উপর স্থাপিত যে বৌদ্ধ ধর্ম, শান্তিপ্রিয় সেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর এমন পরিকল্পিত হামলার ঘটনায়, প্রতীতি বলে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ছিল তা হুমকির মুখে পড়েছে। গণমাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ আর ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ যতোটুকু এসেছে সরেজমিনে দেখে মনে হয়েছে তা দশভাগের এক ভাগও না! এ ঘটনায় অত্যন্ত সুকৌশলে যথাসম্ভব প্রাণহানি এড়িয়ে মানব সভ্যতার কিছু দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য দলিল ধবংস করা হয়েছে; লুট করা হয়েছে স্বর্ণ নির্মিত ধ্যানস্থ বুদ্ধের মূর্তি, বিহার অধ্যক্ষের পাসপোর্ট, দানবাক্সের টাকা; শত শত বছরের পুরোনো বিহার, বুদ্ধমূর্তি, তালপাতায় লেখা ত্রিপিটক, বুদ্ধধাতুসহ অনেক অমূল্য সম্পদকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত মঠ, মন্দির, বিহার, বাড়ি, পানির কল, কম্পিউটার, যাদুঘর, সংগ্রহশালা সব এখন জ্বলন্ত অঙ্গার। পিতলের মতো কঠিন পদার্ধ গলে পি- হয়ে গেছে, গাছের ডাব পুড়ে গিয়ে নারকেলের রঙ ধারণ করেছে।  ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বাইরে শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশসমূহে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে, বাকি বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে। দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে ইতিহাস, সংস্কৃতি  ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা থেকে বিযুক্ত করা ও পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার এই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, আমরা মনে করি, গণহত্যার চেয়েও ভয়াবহ। মৌলবাদ যে মূর্খ, সাম্প্রদায়িকতা যে অন্ধ-আদিম, ধর্মান্ধতা যে অযৌক্তিকÑ এর অবস্থান যে জ্ঞান, বিবেক, সভ্যতা আর যুক্তির বিরুদ্ধে- এটি যে জীবনের বিরুদ্ধে, মানুষের যা শুভ তার বিরুদ্ধে Ñ এ ঘটনায় তা এক লাফে বেরিয়ে এসেছে।

প্রিয় গণমাধ্যম কর্মী

আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন, উত্তম বড়–য়ার নামে ফেসবুকে ট্যাগকৃত যে ছবি পবিত্র কুরআনের অবমাননা করা হয়েছে তা আসলে করেছে মুক্তাদির নামে কক্সবাজারের রামুরই এক বাসিন্দা, যিনি ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। ট্রাকভর্তি দুবৃত্তরা এসে রামুর বৌদ্ধমন্দিরে হামলা চালানোর আগেই এ নাশকতার পূর্ব প্রস্তুতি চলছিল। পোস্টারিং রয়েছে, মাইকিং হয়েছে, হয়েছে মিছিল মিটিং এবং সে সকল মিছিল মিটিং সন্ধা থেকে মধ্যরাত অবদি হয়েছে যেখানে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু মধ্যরাতের পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত বৌদ্ধ মন্দিরে  হামলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবহিত থাকলেও তারা নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন, যা  বহুবিধ প্রশ্নের উদ্রেক করে। পাল্টাপাল্টিা রাজনৈতিক দোষারোপ, রাজনীতির নানা চোরাবালি, আর্থ-সমাজিক ও আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোর জটিল সমীকরণ, র‌্যাব-পুলিশ ও জনপ্রশাসনের বিস্ময়কর নিস্ত্রিয়তা, গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতায় আমরা যাপরানাই ক্ষুব্ধ। আমরা দেখেছি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই থানা থেকে বিহার/বসতবাড়ির দূরত্ব ছিল অত্যন্ত কম। এমনকি ঘটনার পরের দিন পটিয়া ও উখিয়ায় বৌদ্ধবিহারসহ হিন্দু মন্দিরে হামলা করা হলেও প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। পটিয়ায় একটি শিপিং কোম্পানি থেকে শ্রমিকরা এসে বিহার হামলা চালিয়েছে, রামুতে কক্সবাজার শহর থেকে ট্রাকভর্তি লোক এসে অস্ত্র, রামদা নিয়ে এসে বিহার ও  বাড়ি ঘরে গান পাউডার ছিটিয়ে পেট্রোল দিয়ে অগ্নি সংযোগ করেছে, যা নিশ্চিত ভাবে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক  বলে মনে হয়েছে। সাম্প্রতিক মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বৌদ্ধদের হামলার কারণে এ অঞ্চলে মুসলিমদের মধ্যে এমনিতেই একটা চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। একে আরাকান সহিংসতার বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে; এ ঘটনায় রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে বলে মানুষের ধারণা; এ ধরনের আক্রমণের একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতিও থাকে; সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দিয়ে সহজেই তাদের ভিটেমাটি দখল করা যায়; পর্যবেক্ষণ বলে, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অনুপ্রবেশ, আশ্রয়, বসবাস, জীবন-জীবিকা এ অঞ্চলের সমস্যাকে ঘণীভূত ও পরিপক্ক করেছে, এ কারণে আমরা জনমিতির সমিকরণে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর উদ্দেশ্য পরিকল্পনা সম্পর্কেও সজাগ থাকা জরুরি বলে মনে করছি। এতদঅঞ্চলে বহুদিন ধরেই মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতার খবর আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাচ্ছি, পাচ্ছি গহীন অঞ্চলে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকার খবরও।

মানুষের ধারণা খুবই স্পষ্ট যে, এর জন্য দায়ী উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি।  সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-জিঘাংসার শিকার এসব মানুষ এখন তীব্র আতংকে আছে; উগ্র ধর্মীয় মানসিকতা সম্পন্ন আক্রমনকারীরা আর সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধ্বজাধারীরা এখনও আক্রান্ত মানুষদের হুমুক-ধামকি দিয়ে চলেছে। আমরা গভীরভাবে বিচলিত এই কারণে যে, এই নির্মম ধ্বংসলীলা আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন নয়। এর আগে সাতক্ষীরা, হাটহাজারি, চিরিরবন্দর, রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন সময়ে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাত-নিপীড়ন হয়েছে সেইসব পূর্বাপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে এর যোগ আছে; স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সুকৌশলে ধর্মান্ধতাকে এ ক্ষেত্রে উসকে দিয়েছে; মানুষের ধারণা এর পেছনে আছে জামায়াত-শিবির-রোহিঙ্গাগোষ্ঠী ও বিদেশী অর্থায়নে চালিত ধর্মভিত্তিক  সাম্প্রদায়িক এনজিওদেরও সংশ্লিষ্টতা; জামায়াত-রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ধর্মান্ধতা জনতাও এ আগুনে ঘি ঢেলেছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন বিজিবি, সেনাক্যাম্প, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে  নিশ্চিতভাবে অবহিত ছিল। প্রতেকটি বিহারে যাতায়তের রাস্তাও বেশ সুগম। এ হামলা তাই অতর্কিত নয় তবু কেউই ঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু বৌদ্ধরা হামলার বিষয়ে অপ্রস্তুত ছিল কারণ তারা পূর্বে কখনও এর শিকার হয়নি এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে তাদের নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হবে না। কাজেই প্রকৃত তথ্য ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়নি। উপরন্তু বর্তমানে এ প্রশাসনের হাতেই পুনর্বাসনের কাজ চলছে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভায়ও হামলাকারীদের অনেককে দেখা গেছে। স্বরাষ্টমন্ত্রীর অকুস্থল পরিদর্শনের পরেও আবার হামলা হয়েছে। কাজেই স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে এবং তাদের মনোজগতে ভয়ংকর আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় হামলাকারীদের অনেককে চিনলেও  ভয়ে করো নাম বলতে চাইছেন না। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, এ হামলার ঘটনা রোধে সরকারের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ এ হামলা রোধে যদি উপর থেকে আদেশ না গিয়ে থাকে তবে এর দায়ভার সরকারের; অধিকন্তু যদি আদেশ যাওয়ার পরও কাজ না হয় তাহলে এ ব্যর্থতা আরও ভয়াবহ।

প্রিয় সাংবাদিক ভাই-বোনেরা

উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা নাগরিক প্রতিনিধি দল কিছু দাবি জানাচ্ছি:

ক্স     রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা পরিহার করে সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে প্রধান করে এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক।

ক্স     হামলাকারী যে দলেরই হোকনা কেন এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, দ্রুত বিচার আদালতে   তাদের বিচার করা হোক; তদন্তের নামে নিরপরাধ মানুষকে অযথা গ্রেফতার বা হয়রানি বন্ধ করা হোক।

ক্স     ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ, তার প্রতিবিধান ও পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দ্রুততার সাথে গ্রহণ করতে হবে; দ্রুত সকল বিহার/মন্দির সংস্কার ও বাস্তুচ্যুত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষকে পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; বৌদ্ধ বিহার সমূহের হুবহু পুননির্মাণের জন্য ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতি মেনে সংস্কার করতে হবে ও উপকরণ ব্যবহারে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ক্স     সরকার ও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করতে হবে ও  তাদের জন্য শাস্তির বিধান  করতে হবে।

ক্স     ভস্মীভূত আর্টিফেক্ট সংগ্রহ করে যাদুঘর/সংগ্রহশালা বানাতে হবে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম  সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বর্বরোচিত রূপটি দেখে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে নির্মাণে কাজ করতে পারে।

ক্স     দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসেবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়সহ জাতিগত ও সংখ্যালঘু অপরাপর জনমানুষদেরকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনতে হবে; তাদের আস্থা ও নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে হবে; এ কারণে এ অঞ্চলসহ পুরো বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষদের মনে পারস্পরিক অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার অবসান ঘটিয়ে সম্প্রীতির সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে সরকার, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, সিভিল সোসাইটিসহ সবাইকে দীর্ঘমেয়াদে একযোগে কাজ  করার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রিয় গণমাধ্যমকর্মীবৃন্দ

এ বিষয়ে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নাগকির প্রতিনিধি দল সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করবে এবং সময়ে সময়ে আপনাদেরকে এর অগ্রগতি জানাবে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই দরকার নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত, অপরাধী সনাক্তকরণ ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা। প্রকৃত দোষীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত না করলে, পর্যাপ্ত পুনর্বাসন ও ক্ষয়ক্ষতির সংস্কার না হলে এবং সর্বোপরি সম্পর্কের উন্নয়ন তথা আস্থার পুনরুদ্ধার না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে এবং সামনে যে আরও বড় কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে না সে আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ওই অঞ্চলের সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন; আগুনে অঙ্গার হয়েছে অনেক কিছুই; পাঁচ বছর বয়সী তিথির বই পুড়েছে, আশি বছরের বুচি শর্মা দগ্ধ হয়েছেন, পুড়েছে বিবহারের কাঠ এবং অসংখ্য ভিক্ষুর পরনের চীবর; টাকা পেলে পোড়া স্থানে বিহার হবে, আবার বই পাবে তিথি; ভিক্ষুরাও পাবেন চীবর; কিন্তু শত কোটি টাকা দিয়েও আর ফিরিয়ে আনা যাবে না তাল পাতায় লেখা শত বছরের পুরনো ত্রিপিটক; পাওয়া যাবেনা কয়েক শ বছরের বৌদ্ধদের বুদ্ধ ধাতু এবং বৌদ্ধের বক্ষাস্থি দিয়ে তৈরি স্বর্ণ ব্রোঞ্জ ও পিতলের শতাধিক আবক্ষ মূর্তি; আর তার চেয়েও যে বড় সেই মানসিক যে ক্ষতি তা তো কখনই পেষানোর নয়! তবু অবশ্যই দীর্ঘদিনের প্রয়াসে গড়ে তোলা এ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, রক্ষা করতে হবে দেশে-বিদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের সংকাটাপন্ন ভাবমূর্তি। কারণ বাংলাদেশের জন্য সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী পরিচয়টি মূল ও চূড়ান্ত হয়ে গেলে রাষ্ট্রের জন্য তা সমূহ বিপদের কারণ। এ কারণেই সাম্প্রতিক এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আমরা চিহ্নিত করতে চাই মুক্তিুযুদ্ধের চেতনার ওপর সরাসরি আক্রমণ হিসেবে; এই আক্রমণ গণতন্ত্রের ওপর, মানবিক মূল্যবোধের ওপর, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর; এটি জ্ঞান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার ওপর অন্ধ-আক্রমণ; এমনকি একাত্তরেও পাক হানাদার বাহিনী বৌদ্ধবিহারে এরকম আক্রমণ করেনি, যা কিনা করা হলো স্বাধীন এই বাংলাদেশে! আমরা চাই হিংসা-বিদ্বেষ-বিবাদের চির অবসান হোক। কারণ এটি মেনে নেওয়াই তো ভয়ংকর কষ্টকর যে, একুশ শতকে এসেও পৃথিবীটা ধর্মের ভেদরেখা দিয়ে বিভাজিত হচ্ছে। এ জন্য প্রগতিশীল মানুষদের সমন্বয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং সর্বোপরি  রাষ্টকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত করার যে সত্যিকার সেক্যুলার স্পিরিট তাকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সমুন্নত রাখতে হবে।

আপনাদেরকে ধন্যবাদ।

নাগরিক প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেন-

(রোবায়েত ফেরদৌস)

সমন্বয়কারী, নাগরিক প্রতিনিধিদল

সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢকা বিশ্ববিদালয়

মুঠো আলাপন: ০১৭১১-৬১৬-৯৭২

…………………………….

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত নাগরিক প্রতিনিধিদলের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস। সংবাদ সম্মেলনের সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন কাপেং ফাউন্ডেশন ভাইস চেয়ারপার্সন দীপায়ন খীসা। বক্তব্য রাখেন গণ ঐক্যের আহ্বায়ক পংকজ ভট্টাচার্য্য, বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। উপস্থিত  ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর রাসা, আইইডি নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মেদ খান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি তারীক আলী , প্রকৗশলী সরদার আমিন, আহমেদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতিনিধি আহমদ তাবসীর চৌধূরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক রাজীব মীর, আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সদস্য সচিব  এ্যাড. নীলুফার বানু প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে আগামী ১৯ অক্টোবর ২০১২ বিকাল ৩ টায় সকল পেশাজীবি, সাংস্কৃতিক কর্মী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের সম্মিলিত উদ্যোগে নাগরিক প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।

নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্যদের তালিকা:

১.    পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, আহ্বায়ক গণ ঐক্য

২.     সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক ও গবেষক

৩.    মামনুর রশীদ, অভিনেতা ও নাট্যকার

৪.     তারিক আলী, ট্রাস্টি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

৫.    প্রকৌশলী সরদার আমিন

৬.    সালিম সামাদ, সাংবাদিক

৭.     নুমান আহম্মেদ খান,  নির্বাহী পরিচালক , আই ই ডি

৮.    রোবায়েত ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৯.    রাজীব মীর, শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

১০.   দীপায়ন খীসা, প্রতিনিধি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

১১.   অদিতি ফাল্গুনি, গল্পাকার ও মানবাধিকার কর্মী

১২.    ওয়াসফিয়া নাজনীন, মানবাধিকার কর্মী ও পর্বত অভিযাত্রী

১৩.   জাগরণ চাকমা, সিনিয়র রিপোর্টার, দি ডেইলী ইন্ডিপেন্ডেন্ট

১৪.    অনন্ত ইউসুফ, স্টাফ রাইটার, দি নিউ এইজ

১৫.   ইয়াসমিন পিউ, প্রতিবেদক দৈনিক ইত্তেফাক

১৬.   নাইলা বারী, মানবাধিকার কর্মী

১৭.    জুয়েল চাকমা, সাংগঠনিক সসম্পাদক , বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ

১৮.   এ্যাডভোকেট নীলুফার বানু, সাধারণ সম্পাদক , আদিবাসী অধিকার আন্দোলন

১৯.   নাদিয়া, প্রতিবেদক, একুশে টেলিভিশন