নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সংখ্যালঘু গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলার সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন

তদন্ত: ৮ মার্চ ২০১৩

…………………………………..

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সাম্প্রদায়িক হামলা সরেজমিন পরিদর্শন উত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দলের

সংবাদ সম্মেলন

১১ মার্চ ২০১৩, সোমবার, সকাল ১১টা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুন বাগিচা, ঢাকা

 

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ

দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনায় নজিরবিহীন বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে আগুন এবং ভাংচুরের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অশুভ শক্তি আজ সারা দেশেই তা-ব চালাচ্ছে। পতাকা ছিঁড়ছে, শহীদ মিনার ভাঙ্গছে, গণজাগরণ মঞ্চে বোমা মারছে, কুপিয়ে মানুষ হত্যা করছে। তারা একাত্তরেও একই কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও সময় ও সুযোগ বুঝে আবার তারা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা হওয়ার পরপরই দলটির কর্মী-সমর্থক দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায়। দেশের ২০টি জেলায় সংঘটিতএই ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ৫০টির মতো মন্দির এবং এক হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি পোড়ানো হয়েছে। এ আক্রমণের ফলে সম্প্রদায়টির কয়েক হাজার পরিবার পথে বসেছে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ

এ ধরণের ঘটনায় যারপরনাই উৎকন্ঠিত হয়ে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ৬ নং রাজগঞ্জ ইউনিয়নের  আলাদি নগরে হিন্দু মন্দিরে ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতনের যে ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে তা সরেজমিনে দেখার জন্য আমরা রাজনীতিবিদ, সংবাদ কর্মী, শিক্ষক ও  মানবাধিকার কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নাগরিক প্রতিনিধিদল গত ৮ মার্চ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। দিনব্যাপী অনুসন্ধানে প্রতিনিধিদল আক্রান্ত জনপদের বিভিন্ন স্তরের গণমানুষের সাথে কথা বলি, ক্ষতিগ্রস্ত ও ভষ্মীভূত বাড়িঘর, মন্দির পরিদর্শন করি। ভুক্তভোগী মানুষজন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি  ও  সাংবাদিকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করি। এ লেখায় সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

প্রিয় গণমাধ্যমকর্মীগণ

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- রায় ঘোষণার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এই হামলা ছিল সংঘবদ্ধ ও  দেশব্যাপী বিস্তৃত। রাজধানী ঢাকার ১২০ কি.মি. দক্ষিণে রাজগঞ্জের আলাদিনগর গ্রাম। রায় ঘোষণার আগেই স্থানীয় সব স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়। পুলিশ যেন পাড়া-গায়ে ঢুকতে না পারে সেজন্য গাছের গুড়ি দিয়ে রাজগঞ্জ-নোয়াখালী সড়ক ও মাইজদী-রাজগঞ্জ সড়ক আটকানো হয়। দুপুরে স্থানীয় স্কুল মাঠে জামাত-শিবিরের কর্মীদের সভা হয়। বিকেল ৪ টায় কয়েকশ দাঙ্গাকারী মালীপাড়ায় অতর্কিত  আক্রমণ চালায়। বাড়িঘরে হামলা ও লুটের পর ১৮টি বাড়ি পুড়িয়ে ভষ্মীভূত করা হয়। বাজারের পাশেই আলাদিনগর ঠাকুরবাড়ি। পরপর দুইবার হামলা হয় সেখানে। প্রথম হামলা দুপুর ১ টায় হয়। পরেরটি হয় বিকেল ৪ টায়। ৮টি ঘরবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের পর ১টি বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। পাড়ার শতবর্ষীবৃদ্ধ হরধরকে পর্যন্ত মারধর করে তারা। হরি সেবা মন্দির, মনসা মন্দিরসহ দক্ষিণ আলাদিনগরের আরও ২০টি ঘরবাড়িতে হামলা ও লুটপাটের পর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।

সাংবাদিক বন্ধুগণ

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হিন্দু। মুসলমান-হিন্দু দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করছে। লক্ষ্যণীয় হলো এখানে প্রতিটি হামলার সময় পার্শ¦বর্তী মুসলিম পরিবারগুলো এগিয়ে এসে হিন্দুদের সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। রাজগঞ্জেও সেই ধরণের বেশ কিছু শুভবোধ সম্পন্ন মানুষ হামলার সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।  কিছু ক্ষেত্রে জীবনের মায়া ত্যাগ করে হামলার হাত থেকে অনেক হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করেছেন। আক্রান্ত পরিবারের একজন সরস্বতী রানী প্রথমবারের মত এ ধরণের হামলা প্রত্যক্ষ করেছেন বলে প্রতিরিধি দলকে জানিয়েছেন। মিহির চক্রবর্তী নামে এক স্কুল শিক্ষক জানান মুক্তিযুদ্ধের পর আবার তারা হামলার জন্য টার্গেট হলেন। রুম্পা দাস  পুনঃ হামলার আশঙ্কায় ভয়াবহ আতংকের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। স্থানীয়  মানুষজনের মতে, উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী এই প্রচার চালিয়েছে যে, হিন্দুদের সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আদালত সাঈদীর ফাঁসি দিয়েছে। আর এই অজুহাতেই হামলা চালানো হয়েছে। আসলে তারা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করতে চায়। হামলাকারীরা মনে করেন, এসব আক্রমণে ভয় পেয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে চলে যাবেন এবং এতে করে তাদের জমিজমা সম্পত্তি খুব সহজেই হাতিয়ে নেয়া যাবে।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য পরিচিত এই দেশে এই ধরণের হামলা গণতান্ত্রিক চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। মৌলবাদী গোষ্ঠীর পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক দলের মদদ  এ হামলার সক্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে বলে অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ হামলার সাথে  জড়িত  সন্দেহে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে অভিযোগের তালিকায় থাকা অনেককে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। বিশেষ করে অভিযুক্তদের যারা জামাত-শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তারা এখনও গ্রেফতার হয়নি। কাজেই এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

যদিও উপজেলা চেয়ারম্যান ত্রাণের টিন দিয়েছেন, দুএকজন মন্ত্রী এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এবং কয়েকটি পরিবার ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন কিন্তু ক্ষতির তুলায় এ সাহায্য অত্যন্ত অপ্রতুল।

সবচেয়ে ভয়ংকর হলো দীর্ঘদিনের সাম্পদায়িক সম্প্রীতি ও আস্থায় চিড় ধরানোর  চেষ্টা। আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছেন।

প্রিয় গণমাধ্যম কর্মীগণ

মোদ্দাকথা এ ধরণের নৈরাজ্য ও  হামলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। শুধু ৭১ সালের বিরোধীতা নয়, ৪২ বছরেও  মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কাজেই এই অপশক্তিকে প্রতিরোধ করা ছাড়া রাষ্ট্রের হাতে আর কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। এ সহিংস আচরণের কারণে তাদের অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তাই সরকারের কাছে আমাদের স্পষ্ট দাবি ও সুপারিশসমূহ হচ্ছে-

১) এ হামলার উস্কানিদাতা ও নেতৃত্বদানকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত  বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা।

২) ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে যথার্থ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে  হবে।

৩) যেসকল রাজনৈতিক অপশক্তি ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াচ্ছে এবং জননিরাপত্তা বিঘিœত করছে সেগুলোকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণসহ দীর্ঘমেয়াদে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সমাজে যাতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪) সর্বোপরি ভুলে গেলেও চলবে না যে, রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক সেগুলো দূরীকরণার্থে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রিয় বন্ধুগণ

আমরা মনে করি যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত না হলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে সংস্কৃতি তাতে একটি  দীর্ঘমেয়াদী আস্থাহীনতার সৃষ্টি হবে। যার ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। আজ আমরা যে মানবিক প্রলয়ের কথা আপনাদের জানালাম তার চেয়ে মহাপ্রলয় হলো আক্রান্ত মানুষের মনে যে বেদনাবোধ সৃষ্টি হলো- তা। বাড়িঘর সম্পদের ক্ষতি তারা হয়তো দীর্ঘমেয়াদে কাটিয়ে উঠবে কিন্ত তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হলো- তা সারাবে কে? কাজেই এ আক্রমণকে মানবিক বন্ধন ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর  আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করব। আমরা এধরণের সকল ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করবার জন্য আহ্বান জানাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গৌরবদীপ্ত ধারক বাহক এই বাংলাদেশ ধর্মীয় জঙ্গীবাদের আখড়া হয়ে উঠতে পারেনা। আমরা দৃঢ় চিত্তে বলতে চাই বাংলার হিন্দু, বাংলার মসুলমান, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ এবং বাংলার আদিবাসী জনগণ সকলেই এই মাটির সন্তান। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী বাংলাদেশ গড়ে তুলবো, এই আকাংখাকে জিইয়ে রেখে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নাগরিক প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণ এখানেই সমাপ্ত করছি।

নাগরিক প্রতিনিধি দলের পরিচিতি ঃ

১.  পংকজ ভট্টাচার্য্য, আহ্বায়ক, গণ ঐক্য;

২.  তারিক আলীট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর;

৩.  সাংবাদিক সালিম সামাদ;

৪.  রাজীব মীর, সহকারী অধ্যাপক, গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়;

৫.  মামুন আল মোস্তফা, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;

৬.  আবদুল্লাহ জুবেরী, রিপোর্টার, নিউ এইজ;

৭.  দীপায়ন খীসা, সদস্য, কাপেং ফাউন্ডেশন;

৮.  জুয়েল চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ