দিনাজপুরে আদিবাসী গ্রাম সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন
তদন্ত: ১৮-২০ আগস্ট ২০১০
On 18-20 August 2010 an 8 member media team visited different adivasi villages under Birgonj, Chirir Bandar, Phulbari, Nababgonj upazila in Dinajpur District. Mostly Santal indigenous people lives here. The team found that indigenous peoples living in those villages are having different problems including land grabbing, eviction from ancestral land, fabricated cases, physical torture, rape and killing. The team also met and talked with local administration including Additional Deputy Commissioner Mohammad Samshul Alam and Superintendent of Police (SP) Siddique Tanjilul Rahman regarding the issues of indigenous peoples. After the visit all the representatives from print media published exclusive report focusing on different problems of indigenous peoples in their dailies.
দিনাজপুরে আদিবাসীদের জমি থাকা সত্ত্বেও অন্যের জমিতে দিনমুজরের কাজ করে জীবকা নির্বাহ!
কাপেং ফাউন্ডেশন রিপোর্ট
দিনাজপুর জেলায় সাওতাল আদিবাসীদের বসবাস। সেখানে আদিবাসীরা যুগের পর যুগ স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তাদের অনেক জমাজমি ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাদের দিকে তাকালে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তারা আজ ভীটেমাটি হারিয়ে দিনমুজুরের কাজ করে দিনানিপাত করছে।
সম্প্রতি দিনাজপুরের আদিবাসী অঞ্চল বীরগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, চিরিরবন্দর ও ফুলবাড়ী উপজেলার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের জমি হারানো, বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন-নিপীড়ণ ও গণধর্ষণসহ অনেক রকম কাহিনী।
বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর গ্রামের সভা মুরমু স্বামী রবেন হাসদা তাদের ভিটেবাড়ি ২০ শতক জমি নিয়ে মামলা করে নিজের নামে রায় পেলেও তিনবার করে জমি দখল করে। নিজের জমিতে ঘর করার ষোল দিনের মাথায় তার ঘর ভেঙ্গে দেয় এবং প্রায় শ দু’য়েক লোকের সামনে সভা মুরমু ও তার স্বামী রবেন হাসদাকে বিবস্ত্র করে। তার স্বামী রবেন হাসদাকে মেরে হাত থেতলে দেয়। এখন তারা নিজের ভিটে মাটিতে বসবাস করতে পারছে না।
একই উপজেলার চক বানারসি গ্রামের বাসিন্দা সালগিন হেমরমের (৭০) স্বামী চ-ু মার্ডি মারা গেছেন বছরখানেক আগে। একমাত্র ছেলেটিও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। স্বামী মারা যাওয়ার পর বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তার আট একর ধানি জমি দখল করে বসেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। জমি হারিয়ে বৃদ্ধ বয়সে অন্যের জমিতে শ্রমদাস হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, জমি দখলকারীরা আমাকে ভিটে ছাড়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। একই উপজেলার মাটিয়াকুড়া গ্রামের রামবাই হাসদা (৯৬) বেদখল হয়ে যাওয়া দুই একর ৩৮ শতক জমি ফিরে পেতে স্থানীয় ভূমি অফিসে মামলা করেছিলেন। মামলার রায়ও তাঁর পক্ষে ছিল কিন্তু পেশীশক্তির কাছে হার মেনে দখলদারদের কবল থেকে তিনি জমি উদ্ধার করতে পারছেন না।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে আদিবাসী এলাকায় খুন, গণধর্ষণ ও সাঁওতাল নারীকে বিবস্ত্র করার একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। আদিবাসী নেতারা এসব ঘটনার প্রতিকার দাবি করে বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, সরকারি প্রশাসন কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করেছেন। কিন্তু কোন প্রতিকার পাননি।
নবাবগঞ্জের জয়পুর আমলাকাঁঠাল গ্রামের উমতি হেমরম (৪৫) জানান, ১৯ একর ১২ শতক জমির দখলকে কেন্দ্র করে ভূমিদস্যুরা ২০০৮ সালের ৬ জুন তার স্বামী সরকার টুডু এবং অপর আদিবাসী সোম হাসদাকে নির্যাতন করে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাওয়ায় ১২ জুন আদালতে হত্যা মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই মামলার আসামি আবুল মেম্বার, বাবুল, কামাল, দুরুল, মন্তাজ ও লোকমান মেম্বার প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। তাদের আজও গ্রেফতার করা হয়নি। অবশিষ্ট বাকী জমিটুকুও দখলদাররা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
ফুলবাড়ীর আলুডাঙ্গা গ্রামের একজন ধর্ষিতা সাঁওতাল নারী জানান, খাস জমিতে বসবাসরত ১২টি আদিবাসী পরিবার দিনমজুরি করে জীবন যাপন করছে। তাদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য স্থানীয় একটি মহল গত কয়েক বছরে ধরে গ্রামটিতে বেশ কয়েকবার আগুন দিয়েছে। ধর্ষিতা জানান, তার নিজের ঘরটিই পাঁচবার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত মে মাসে মমিনুল, জাহিদুল, বেল−াল, বিধু ও মোনাক তাকে গণধর্ষণ করে। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিলে গ্রামের মাতব্বরা সালিস করে ধর্ষকদের মাত্র দুই হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সেই দুই হাজার টাকা ধর্ষিতা পায় মাত্র এক হাজার টাকা, পুলিশকে দিয়েছে পাঁচ শত টাকা এবং বাকী পাঁচ শত টাকা এলাকার মাতাব্বরা ভাগ করে নিয়ে নেয়।
চিরিরবন্দর উপজেলার কাঁটাপাড়ায় গিয়ে জানা গেছে, সেখানেও দিন দিন বেদখল হয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের জমিজমা। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে আদিবাসীরা তিন একর ২৪ শতক খাস জমিতে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছি কিন্তু বছর দুয়েক হলো দখলদাররা কবরস্থানের প্রায় দুই একর জমি দখল করে ধান চাষ করছে। কবরস্থানের বাকি অংশটুকুও দখল করার জন্য এখন সেখানে নানা ধরনের গাছ ও বাঁশের চারা লাগাচ্ছে।
বীরগঞ্জের বোচাপুকুর গ্রামে ৯ একর জমির দখলকে কেন্দ্র করে ২০০২ সালে গণধর্ষণের শিকার হন আরেক সাঁওতাল আদিবাসী নারী। তিনি জানান, অভিযুক্ত ধর্ষকরা হচ্ছে হাবিবুর, মানিক, নয়ন, হীরা, বাবুসহ ছয় আসামির সবাই প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। ধর্ষণের বিচার আজও হয়নি। উপরন্তু তার স্বামীর যতটুকু জমি ছিল সেটিও আজ হারিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিণত হয়েছেন দিনমজুরে এবং বসবাস করছে বাবার বাড়ীতে।
নিজেদের নামে থাকা সত্ত্বেও জমি দখলে নেই বীরগঞ্জ উপজেলার লেদেম সরেনের তিন একর, রামবাই হাসদা’র দুই একর ৩৮ শতক, বাপই মার্ডির তিন একর, বাবুরাম বেছরা’র তিন একর, শীতল মার্ডিসহ আরো ছয় ভাইয়ের ১৮ একর, সুক্রাম হাসদা, সুরেশ মুরমু, চিরিরবন্দর উপজেলার রেখা হাসদা’র ৪২ একর ১৩ শতক সহ আরো অনেক সাওতাল আদিবাসীদের জমি আজ নিজের দখলে নেই।
দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামসুল আলম বলেন, ‘আদিবাসীরা শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে আছে। এ কারণে কোনো কোনো দখলদার চাপের মুখে তাদের জমিজমা থেকে উৎখাতও করে থাকতে পারে বলে আমরা জেনেছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা এ বিষয়ে তৎপর হতে পারি। তবে আদিবাসীরা যেন কোনো রকম চাপের মুখে জমিজমা বিক্রি না করে, আমরা সে চেষ্টা করছি। এর পরও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়া আদিবাসীদের জমি বেচা-কেনা হচ্ছে কিন্তু এটা বৈধ হবে না।’
দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তাঞ্জিলুর রহমান এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, আদিবাসীরা লেখাপড়া জানে না বলে, একটি মহল তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিচ্ছে। তারা যেন হয়রানির শিকার না হয়, সুবিচার পায়, সেটি দেখা পুলিশের কর্তব্য। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই পুলিশ যথাযথ আইনি ভূমিকা রাখবে।
আদিবাসী হত্যা ও গণধর্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত কোনো হত্যা মামলা অমীমাংসিত নেই। পুলিশ সব মামলায় চার্জশিট দিয়েছে। একটি ধর্ষণ মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন। অপর ধর্ষণ মামলাটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তবেই তথ্য দেওয়া সম্ভব।