চিরিরবন্দরে সংখ্যালঘুদের উপর ও নওগাঁয় এক আদিবাসী দিনমজুরকে হত্যার ঘটনা সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন
তদন্ত: ২৭-২৯ আগস্ট ২০১২
……………………………………………….
দিনাজপুর চিরির বন্দরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, আদিবাসী নারী ধর্ষন ও হত্যা এবং নওগাঁতে এক আদিবাসী দিনমজুরকে হত্যার ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শন উত্তর
সংবাদ সম্মেলন
স্থান ঃ সম্মিলিত সামজিক আন্দোলন কার্যালয়, ৩১ আগষ্ট ২০১২, শুক্রবার, সকাল ১১ টা
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
শুভেচ্ছা নিন।
সম্প্রতি দিনাজপুরের চিরির বন্দরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, আদিবাসী নারী ধর্ষণ ও হত্যা এবং নওগাঁতে এক আদিবাসী কৃষককে হত্যার ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল সফর করে। ২৭, ২৮ ও ২৯ আগষ্ট ২০১২ তিনদিনব্যাপী এই সফরে প্রনিতিনিধিদল আক্রান্ত গ্রামবাসী, পরিবারের সদস্য, স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী , বিভিন্ন পেশাজীবি ও প্রশাসনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
২৭ আগষ্ট ২০১২ প্রতিনিধিদল দিনাজপুর জেলার কাহালুর থানাধীন ১০ মাইল এলাকার গড়নুরপুর গ্রামে যান। সেখানে ১৬ আগষ্ট দিবাগত রাতে পাওলিনা হাঁসদা পারুল (২৭) নামের এক সাাঁওতাল আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। প্রতিনিধিদল পাওলিনা হাঁসদার জীর্ণ-শীর্ণ এক কামরার কুঁড়েঘরের উঠানে তার ভাই ভীমসেন হাঁসদার সাথে কথা বলেন। তিনি জানান বাসায় তৈরীকৃত দেশীয় মদ পান করার জন্য স্থানীয় কিছু পরিবহণ শ্রমিক দেলোয়ার, জালাল ও আশরাপুল সহ ৪-৫জন ১৬ আগষ্ট তাদের বাসায় আসে। মদ পান করার এক পর্যায়ে তারা জোরপূর্বক তার বোন পাওলিনা হাঁসদাকে ধর্ষণ করে এবং পরে নির্যাতন করে তাকে শ্বাাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর তারা চলে যায়। পাওলিনার ভাই ভীমসেন স্থানীয় কাহালুর থানায় বিষয়টি অবহিত করেন এবং একটি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ধর্ষক ও খুনীদের এখনও পুলিশ গ্রেফতার করেন। পাওলিনার ৬ষ্ট শ্রেণী পড়ুয়া এক মেয়ে রয়েছে। হত দরিদ্র এই সাঁওতাল পরিবারটি এখন চরম আতংকের মধ্যে দিন যাপন করছে।
সুপ্রিয় বন্ধুগণ,
২৮ আগষ্ট ২০১২ প্রতিনিধিদল দিনাজপুরের চিরির বন্দর যান। আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন ৪ আগষ্ট চিরির বন্দরের বলাই বাজারে কথিত মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুঠপাট চালানো হয়। ঘটনার প্রায় একমাস অতিবাহিত হতে চললেও সেখানে জীবন যাপন এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বিধ্বস্ত এই জনপদের আক্রান্ত গ্রামবাসীরা এখনও ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছে। বলাই বাজারের জনৈক এক ব্যবসায়ী হামিদা বানু চৌধুরী তার বরাদ্দকৃত দোকানের একটি প্লটে মসজিদ নির্মাণ করার উদ্যেগ নেন। এই দোকানের প্লটের সামনেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি মন্দির রয়েছে। তাই এলাকাবাসী প্রশাসনের নিকট বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে সাম্প্রদায়িক উস্কানী দিয়ে মসজিদে মসজিদে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। ৪ আগষ্ট শনিবার হামিদা চৌধুরী তার কথিত মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য হাজারো লোকজন সমবেত করার উদ্যোগ নেন। ৩ আগষ্ট প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারী করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারীর পরও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে নসিমন, ভ্যান, ট্রাক যোগে শত শত লোককে বলাই বাজারে নিয়ে আসা হয়। প্রশাসন তার নিজের জারীকৃত ১৪৪ ধারা রক্ষায় উদাসীন থাকে। আগত এই জনতার উদ্দ্যেশে হামিদা চৌধুরী পুলিশের হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে ধর্মীয় উস্কানীমুলক বক্তব্য প্রদান করতে শুরু করে বলে এলাকাবাসী প্রতিনিধি দলের কাছে অভিযোগ করে।
এলাকাবাসী প্রতিনিধিদলকে আরো জানান পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আগত জনতা বলাই বাজরের সন্নিকটস্থ কবিরাজ পাড়া আক্রমণ করে। প্রকাশ্য দিবাললোকে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে কবিরাজ পাড়ায় একের পর এক বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করা হয় ও লুঠপাট চালানো হয়। দু®কৃতিকারীরা গরু, বাছুর, ছাগল সহ বাড়ীর আসবাবপত্র, গহনাদি-স্বর্ণালংকার লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। উদ্বেগের বিষয় এই সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এই তান্ডবলীলাকে থামাতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠি চার্জ, টিয়ারগ্যাস কিংবা গুলি ছুঁড়া এইরকম কোন কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১কিমি দূরে মাঝ পাড়া গ্রামেও একই কায়দায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাঠ চালানো হয়। প্রশাসন সেসময়ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল।
প্রিয় গণমাধ্যমের সহযোদ্ধাগণ,
প্রতিনিধিদল মনে করে চিরির বন্দরের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মীয় মৌলবাদী চক্র ধারাবাহিকভাবে যে হামলা আক্রমণ চালাচ্ছে এটা তারই একটি অংশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার জন্য জামায়াতে ইসলামী সুপরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা পচিালনা করছে। প্রশাসনের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা মৌলবাদী চক্রের সদস্যরা এই সকল হামলায় ইন্ধন যোগাচ্ছে। চিরির বন্দরের ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা আমাদেরকে সে বিষয়টি আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়। হামলার ১ মাস অতিবাহিত হতে চললেও চিরির বন্দরের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী সেখানে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। আবারও হামলার আশংখাকেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা। অনেক বাড়ীতে এখনও লোকজন বাড়ী ফিরে আসেনি। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও তেমন পর্যাপ্ত নয়। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের সাথে প্রতিনিধিদল ২৮ আগষ্ট তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসককে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান এবং পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করেন। জেলা প্রশাসক প্রতিনিধি দলকে জানান উচ্চ আদালাত থেকে মামলার মূল আসামীরা আগাম জামিন নিয়েছেন। মামলার ধারা জামিন অযোগ্য হলেও রাষ্ট্রপক্ষের কর্তব্য অবহেলা এবং মামলার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় না আনা সর্বোপরি পুলিশের তদন্তের গাফিলতির কারণে মূল আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে প্রতিনিধি দলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। অবশ্য জেলা প্রশাসক প্রতিনিধিদলকে অভিহিত করেছেন চিলির বন্দরের ইউএনও- কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ওএসডি করা হয়েছে। প্রশাসনের একটি তদন্ত কমিটিও কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জেলা প্রশাসক প্রতিনিধি দলকে জানান। প্রতিনিধিদল আদিবাসী নারী পারুলের ধর্ষণ ও খুন হওয়ার বিষয়টিও জেলা প্রশাসককে অভহিত করেন।
প্রিয় সংবাদ কর্মীগণ,
২৯ আগষ্ট ২০১২ প্রতিনিধিদল নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলায় যান। সেখানে জাম্বু চাঁড়ে নামক এক আদিবাসী কৃষক হত্যকা-ের বিচারের দাবীতে আয়োজিত মানববন্ধনে প্রতিনিধি দলের সদস্যসরা সংহতি জানান। ১০ আগষ্ট ২০১২ জাম্বু চাঁড়ে আঙ্গরত গ্রামে জমিতে আমন ধান রোপার সময় স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী তাকে বাধাপ্রদান করে। জাম্বু তার প্রতিবাদ করলে জয়নাল, আতিকুল, রেজাউল, খোকন প্রমুখ সন্ত্রাসীরা তাকে আক্রমণ করে। চাকু, লাঠি দিয়ে তার পিঠে জখম করে। সন্ত্রাসীরা জাম্বুকে লাঠি দিয়ে পেঠাতে থাকে, চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি নির্মমভাবে আঘাত করে এবং বর্বরভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে খুন করে। স্বামীর হত্যকারীদের গ্রেফতারের দাবীতে জাম্বুর স্ত্রী ১০ দিনের সন্তানকে কোলে করে মানববন্ধনে যোগ দেন। বিষয়টি খুবই হৃদয়বিদারক। তার চেয়েও যে বিষয়টা উদ্বেগের তা হল এখনও পর্যন্ত এজাহাভুক্ত কোন আসামী গ্রেফতার হয়নি। জাম্বু চাঁড়ের সদ্য বিধবা হওয়া স্ত্রী মাত্র দেড় বছরের সংসার জীবন কাটিয়ে ১০দিনের শিশু কোলে নিয়ে স্বামী হত্যার বিচার চাইতে রাস্তায় প্রতিবাদ করছেন। প্রশাসন এরপরও কিভাবে নির্বিকার থাকে তা আমাদের বোধগম্য নয়। কর্তৃপক্ষ জাম্বু চাঁড়ের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ কিংবা কোনপ্রকার সহযোগিতা করেনি। প্রতিনিধি দল ধামইরহাট ইউএনও-র সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে জাম্বু চাঁড়ের বিষয়টি অবহিত করেন এবং আসামীদের গ্রেফতারের দাবী জানান।
সুপ্রিয় কলম যোদ্ধাগণ,
উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে আমরা দেশের প্রান্তিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমাল ও তাদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে আমরা সরকার ও কর্তৃপক্ষের কাছে নিম্নলিখিত দাবী তুলে ধরছি—–
ক. চিরির বন্দর সংক্রান্ত:
১. চিরির বন্দরে বলাই বাজারের আক্রান্ত সংখ্যালঘু জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেখানে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করতে হবে।
২. দায়িত্ব অবহেলার জন্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. আসামীদের জামিন বাতিলের জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং মামলার যথাযথ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
খ. আদিবাসী নারী ধর্ষণ ও খুন সংক্রান্ত:
১. পারুলের ধর্ষণকারী ও খুনীদের গ্রেফতার করতে হবে।
২. পারুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণী পড়–য়া মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গ. জাম্বু চাঁড়ের হত্যাকান্ড সংক্রান্ত:
১. জাম্বু চাঁড়ের খুনীদের গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
২. জাম্বু চাঁড়ের স্বামীহারা স্ত্রী ও তার ১০ দিনের শিশুর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
শুভেচ্ছাসহ
প্রতিনিধি দলের পক্ষে
পংকজ ভট্টাচার্য্য
আহ্বায়ক, গণ ঐক্য কমিটি ও প্রতিনিধিদলের প্রধান
দ্রষ্টব্য: ৩১ আগষ্ট ২০১২, শুক্রবার, সকাল ১১ টা সম্মিলিত সামজিক আন্দোলন কার্যালয়ে দিনাজপুর সিরির বন্দরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, আদিবাসী নারী ধর্ষন ও হত্যা এবং নওগাঁতে এক আদিবাসী দিনমজুরকে হত্যার ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শন উত্তর এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন গণঐক্য কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য্য। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপার্সন দীপায়ন খীসা। এই ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ বিরোধী মঞ্চের সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. নূর মোহম্মদ তালুকদার, গণতান্ত্রিক আইনজীবি সমিতির নেতা এ্যাড. এস এম সবুর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
নাগরিক প্রতিনিধিদলে ছিলেন-
১. পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সভাপতি, গণঐক্য
২. ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার, সদস্য-সচিব, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ বিরোধী মঞ্চ
৩. রবীন্দ্রনাথ সরেন, সভাপতি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও কাপেং ফাউন্ডেশন
৪. দীপায়ন খীসা, ভাইস চেয়ারপার্সন, কাপেং ফাউন্ডেশন
৫. এ কে এম আইকুজ্জামান, সংবাদদাতা, নিউ এজ