টেকনাফ উপজেলায় চাকমা পল্লীতে হামলার সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন

তদন্ত: ৭ জুন ২০১২

…………………………………….

টেকনাফ উপজেলায়  চাকমা পল্লীতে হামলা, ঘর-বাড়ী ভাঙচুর এবং নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা প্রসঙ্গে

নাগরিক প্রতিনিধিদলের বিবৃতি

সমবেত সুধী,

শুভেচ্ছা নিন ।

আমরা গভীর উৎকন্ঠা ও উদ্বেগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছি যে, অতি সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসী জনগণের উপর আক্রমণ, সহিংসতা, হত্যা এবং নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দেশের বিবেকমান মানুষদেরকে নাড়া দিচ্ছে এবং সহিংসতার ব্যাপকতা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত ২৯ ও ৩০ মে ২০১২ কক্সবাজার টেকনাফ উপজেলায় হোঁয়াকো চাকমা পল্লীতে ভূমিগ্রাসী ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কতৃক নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর গণ-হামলা, ঘর-বাড়ী ভাঙচুর এবং সন্ত্রাসীদের কতৃক নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।

প্রিয় জনতা,

হোঁয়াকো শুকনা আমতলী গ্রামে সংগঠিত ঘটনাবলী সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল ৭ জুন ঘটনাস্থল সফর করে। প্রতিনিধিদল আক্রান্ত গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলেন এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথেও মতবিনিময় করেন।

সুপ্রিয় সমাবেশ

আমরা সরেজমিন পদির্শনকালে অসহায় আদিবাসী পরিবারের হাহাকার ও আর্তনাদ শুনেছি। অনেক ভীত স্বন্ত্রস্ত মুখের দেখা মিলেছে, তাদের আকুতি ও বেদনার ভাষা প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মনকে ভারী করে দিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত আব্দুল হক নামের এক ভূমিগ্রাসী দলবল নিয়ে ১১ মে ২০১২ শিম্প্রুঅং চাকমার জায়গা দখল করতে আসলে গ্রামবাসী ভূমিদূস্যদের প্রতিরোধ করে। এর পর পরই আব্দুল হক শিম্প্রুঅং চাকমার বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় মামলা করে। ১২ মে একই ঘটনা নিয়ে শিম্প্রুঅং চাকমা আব্দুল হকের বিরুদ্ধে কক্সবাজার মেজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। ২৯ মে আব্দুল হক স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের সাথে নিয়ে রাত আনুমানিক ৯টায় শিম্প্রুঅং চাকমার পরিবারের সদস্যদের ধরতে শুকনা আমতলী গ্রামে যান। আব্দুল হক বাহিনী ও সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা শিম্প্রুঅং চাকমার বাড়ী থেকে তার ছেলেদের ধরে আনতে চাইলে তারা ডাকাত ডাকাত বলে গ্রামবাসীর সাহায্য চায়। গ্রামবাসী এগিয়ে আসলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে আব্দুল হক বাহিনী ও সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা আহত হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। ৩০ মে ঘটনাস্থল থেকে মারাত্মক আহত অবস্থায় এক পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। এর পর ৩০ মে ভোর রাতে আনুমানিক ৪টার সময় পুলিশ আসামী ধরার অজুহাতে আবদুল হক বাহিনীকে সাথে নিয়ে শুকনা আমতলী গ্রামে নির্বিচারে হামলা চালায়। ভোর রাতে প্রতি ঘরে ঘরে তল্লাশি চালানো হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের না পেয়ে প্রতিটি ঘরের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধন ও লুঠ-পাট করা হয়। গৃহে অবস্থানরত নারীদের লাঠি-সোটা দিয়ে আঘাত করা হয়।

সংগ্রামী উপস্থিতি,

আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে জানাচ্ছি যে, আক্রান্ত গ্রামবাসী প্রতিনিধি দলের সদস্যদের কাছে অভিযোগ করে ভূমি দূস্য আব্দুল হক বাহিনী ৩০ মে ভোর রাতে পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় যে তা-ব চালায় তাতে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা রুইমে চাকমাকেও লাঠি পেটা করা হয়। কমপক্ষে ২জন কিশোরীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছে বলে প্রনিধিদলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই ছাড়াও ৪-৫টি ঘরের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। প্রতিধিদলের কাছে গ্রামবাসী অভিযোগ করেছে আব্দুল হক বাহিনী কতৃক ২ থেকে ৩টি ঘরে লুঠপাট চালানো হয়েছে। নগদ টাকা লুণ্ঠন ও নারীদের পরিধেয় স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ৮ মাসের এক সন্তান সম্ভাবা নারীকেও পুলিশ লাঠিপেটা করে। প্রতিনিধি দলের কাছে আক্রান্ত মহিলা ঘটনার বিবরণ বর্ণনা করেন। ১টি গৃহের বুদ্ধ আসন ভাংচুর করা হয় এবং বুদ্ধ মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। প্রতিনিধিদল ঘটনায় আক্রান্ত এক কিশোরীর ভয়ার্ত ও অসহায় মুখ দেখতে পেয়েছে। চোখে-মুখে আতংকের ভাষা ছড়িয়ে থাকা ঐ কিশোরী ঠিকমত কোমর সোজা করেও দাঁড়াতে পারছিল না। প্রতিনিধিদলের বয়োজ্যোষ্ঠ সদস্য পংকজ ভট্টাচার্য ঐ কিশোরীর সাথে নিবিড় আলাপ করলে কিশোরী জানান ৩ জন দুর্বৃত্ত তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে।

প্রিয় জমায়েত,

উপরোক্ত ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। বিশেষ করে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ভূমিদূস্যদের সখ্যতা আমাদেরকে বিবেককে ভাবিয়ে তুলে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সদস্যদের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীদের কর্তৃক গ্রামবাসীদের ঘর-বাড়ী লুণ্ঠন, নারীদের শ্লীলতাহানির বিষয়টি প্রতিনিধিদলকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। প্রতিনিধি দল কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবহিত করে। তিনি ঘটনাবলীর সাথে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পুলিশ সুপার অভিযোগ করেন গ্রামবাসী এক পুলিশ সদস্যের পায়ের রগ কেটে দেয়। এরপর প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জেলা প্রশাসক ঘটনা অবহিত আছেন বলে প্রতিনিধি দলকে জানান। এই ছাড়াও প্রশাসন নিরীহ গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট থাকবে বলে তিনি প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্থ করেন।

সংগ্রামী বন্ধুগণ,

নাগরিক প্রতিনিধি দল কক্সবাজার টেকনাফের আদিবাসীদের প্রান্তিক জনপদে পুলিশী হামলা এবং তাদের সাথে ভূমিগ্রাসীদের মিত্রতার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সেই সাথে পুলিশ বাহিনীর এক সদস্যের পায়ের রগ কেটে দেয়ার বিষয়টিকে একটি পরিকল্পিত চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে। প্রতিনিধি দল এটা স্পষ্টভাবে বলতে চায়, যে কায়দায় পায়ের রগ কাটা হয়েছে তা নিরীহ গ্রামবাসীর পক্ষে সম্ভব নয়। যাবতীয় তথ্য        বিচার-বিবেচনা করে প্রতিনিধিদলের মনে হয়েছে যে, নিরীহ গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগকে আক্রমণাত্মক করে তোলার দূরভিসন্ধি থেকে পায়ের রগ কাটায় সিদ্ধহস্ত কোন বিশেষ বাহিনীই এই কাজটি করতে পারে। প্রতিনিধি দল মনে করছে পুলিশ প্রশাসন এই দিকে দৃষ্টি দিতে পারে।  প্রতিনিধি দল মনে করছে পুলিশ প্রশাসন সেই দিকে দৃষ্টি দেয়নি। এই বিষয়টি মনোযোগ দিলে পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তা না হলে সাম্প্রদায়িক একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ফাঁদে পা দিয়ে পুলিশ বাহিনী ভূমিদস্যুদেরই প্রকান্তরে সাহায্য করবে। এই নাগরিক সমাবেশ থেকে আমরা নিম্নলিখিত সুপারিশমালা সরকারের নিকট তুলে ধরছি—

        অবিলম্বে  কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার হোঁয়াকো আমতলী গ্রামে পুলিশ বাহিনী সদস্যদের বিতর্কিত কার্যকলাপের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।

        পুলিশ ও ভূমিদস্যু কর্তৃক গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেফতারকৃত নিরীহ গ্রামবাসীদের মুক্তি দিতে হবে।

        বিতর্কিত হোঁয়াকো পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের প্রত্যাহার করে গ্রামবাসীদের পুলিশের প্রতি আস্থা স্থাপনের প্রক্রিয়া দ্রুত আরম্ভ করতে হবে।

        নারীদের শ্লীলতাহানি, লুঠ-পাটকারী দু®কৃতিকারীদের গ্রেফতার এবং রগ কাটার বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

        ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের সুচিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৬ জুন ২০১২, সোমবার, সকাল ১০.৩০টা, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নাগরিক প্রতবাদ সমবেশ থেকে উত্থাপিত দাবীনামা। নাগরিক প্রতিনিধিদলে ছিলেন-

১.     পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সভাপতি, গণঐক্য

২.     নুমান আহমদ খান, নির্বাহী পরিচালক, আই ই ডি;

৩.     সালিম সামাদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক;

৪.     শান্তুনু মজুমদার, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;

৫.     ফিরোজ জামান চৌধুরী, সাংবাদিক, প্রথম আলো;

৬.     দীপায়ন খীসা, ভাইস চেয়ারপার্সন, কাপেং ফাউন্ডেশন

৭.     ওয়ালিউর রহমান তন্ময়, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

৮.     জুয়েল চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ